অন্ধকার জগতের ‘রাজা’ নুরু
অন্ধকার জগতের ‘রাজা’ নুরু
নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ১ জানুয়ারী ২০২১ ১৯:৪৪; আপডেট: ২ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:১৩

পাহাড়ের জমি অবৈধভাবে বিক্রি ও ভবন নির্মাণ, ইয়াবা কারবার, কাঠ পাচার, অস্ত্র কেনাবেচা এবং ভয়ভীতির জন্য ভাড়ায় মাস্তান পাঠানোসহ চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। নগরীর আকবর শাহ থানার নাছিয়াঘোনার ১ নম্বর ঝিল এলাকার নুরে আলম নুরু নামে এই ব্যক্তি এলাকার উঠতি বয়সীদের কাছে ‘ডন’ বলেই পরিচিত। ২৪ মামলার আসামি নুরুকে ভাই নামেই সম্বোধন করে তারা। আর স্থানীয় পুলিশও যেন তার কাছে অসহায়। যার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক একটি অভিযানে। কয়েক দিন আগে আকবর শাহ থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যৌথ দল অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে নুরুর সাম্রাজ্য থেকে।
গত ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে নুরুকে গ্রেপ্তারে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যৌথ দল নাছিয়াঘোনার ১ নম্বর ঝিল এলাকায় অভিযানে যায়। অবশ্য তার ডেরায় পৌঁছানোর আগেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে নুরু বাহিনীর সদস্যরা। সেদিনের অভিযানের শুরুতে প্রথমে নুরুকে পাওয়া যায়নি। পরে পরিকল্পনামাফিক সন্ধ্যা নামার আগে নুরুর নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে নুরু বাহিনীর তোপের মুখে ফিরে আসেন পুলিশ সদস্যরা। অবশ্য সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নুরুর সহযোগী আজমকে। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার নুরুর একই আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এক নারী সদস্যসহ তার বাহিনীর সক্রিয় ১২ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের যৌথ দল। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ১৫০ পিস ইয়াবা এবং কিরিচ, ছোরা ও চাপাতি। আর অভিযানের খবর পেয়ে নুরু আগেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
নাছিয়াঘোনার ১ নম্বর ঝিল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি মোড়ে বসানো হয়েছে নুরু বাহিনীর সদস্যদের পাহারা। ১ নম্বর ঝিলের পাহাড় এবং ফিরোজ শাহ এলাকায় পুলিশ ও সাংবাদিকদের গতিবিধি নজরদারিতে বেশিরভাগ দোকান, সড়কে নুরুর লোক চষে বেড়াচ্ছে।
১ নম্বর ঝিল এলাকার নুরু পাহাড় কেটে যেসব কলোনি তৈরি করেছে সেখানে গত কয়েক দিন ঘুরেও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে প্রবেশ করা যায়নি। জানা গেছে,অন্ধকার জগতের ‘রাজা’ নুরু আকবর শাহ থানা এলাকার ‘ডন’ নুরু মাদক কারবার, অস্ত্র কেনাবেচা ও বহনের মাধ্যম, জমি দখল এবং মাস্তান সরবরাহের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে গত আট বছর ধরে। আগে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ নিজে একাই করলেও এখন আস্তানা গেড়ে ইয়াবার কারবার, কাঠ পাচার ও পাহাড় দখল করে জমি বিক্রির মতো অপরাধে জড়িয়েছে।
ফিরোজ শাহ কলোনির বাসিন্দা মো. নুরুচ্ছফা বলেন, ‘তার (নুরু) বাবা একসময় ঝিলের মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করতেন। তার বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে নুরুর মা, ভাইবোন ও ভগ্নিপতিসহ সবার নামে মামলা আছে। এককথায় পারিবারিকভাবে তারা সবাই অন্ধকার জগতের মানুষ। নুরু হলো সেখানের কিং। কারও সম্পদের ওপর লোভ পড়লে অপহরণ করে তুলে নিয়ে আসবে। নুরুর নিরাপত্তায় তখন আশপাশে ২০ জনের বেশি ছুরি-অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেয়। ঝিলের পাহাড় থেকে নুরু কখনো বের হয় না।’
নাছিয়াঘোনা এলাকার এক স্থায়ী বাসিন্দা নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে নুরুর বিষয়ে কথা বলতে সম্মত হন। তিনি বলেন, ‘নুরু সরকারি পাহাড় কেটে সমতল করে প্লট বিক্রি করছে। সেখানে জুয়ার আসর বসে দিন-রাত। পাহাড় থেকে নুরু বের হয় না। তার বোনও লোকজনকে এখানে এনে বেঁধে রেখে নির্যাতন করে। ইয়াবার চালান এবং অস্ত্র বেচাকেনা করে তার বোন রুবি বেগম ও ভগ্নিপতি আলমগীর। কক্সবাজার থেকে যেসব ইয়াবার চালান আসে তা ফিরোজ শাহ কলোনির মুখ থেকেই সশস্ত্র পাহারায় আনে নুরুর পোলাপান।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আকবর শাহ থানা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘এলাকার সাবেক কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম জসীম একসময় তাকে (নুরু) সাপোর্ট দিত, তবে বর্তমানে উল্টো নুরুর সাপোর্ট খোঁজে। বর্তমানে নুরু একটি ক্রাইম ফিগার।’
সন্ত্রাসী নুরুর অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে একই এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ রমিজউদ্দিন বাবু বলেন, ‘নুরু বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্নজন টাকা নিয়ে ভাড়ায় নিয়ে যায়। মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য এসব সন্ত্রাসীকে জনপ্রতি সর্বোচ্চ দর তুলে ভাড়া পাঠায় নুরু। আমরা মুখ ফুটে সাহস নিয়ে বলছি, অনেক মানুষ ভয়েও বলবে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ, সাংবাদিক বা অন্য কেউ যদি নুরুর খোঁজ করতে এলাকায় আসেন তাহলে সে খবর মিনিটেই পৌঁছে যায় তার কাছে। একইভাবে গত ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ আসার খবরটি তার সোর্সরা মুহূর্তেই পৌঁছে দেয়। আকবর শাহ থানার নাছিয়াঘোনা এলাকায় কেউ ভবন নির্মাণ করলে কিংবা কেউ বাসার টিন লাগালেও নির্মাণসামগ্রী নুরুর কাছ থেকে কিনতে হয়। ওই সাম্রাজ্যে ইট, বালি, সিমেন্ট, টিন ও রডসহ সবকিছুর ঠিকাদার নুরু। বাজারমূল্য থেকে দ্বিগুণ দামে এসব না কিনলে কেউ সেখানে বাড়ি করতে পারে না বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী। নুরুর সাম্রাজ্যে রয়েছে মসজিদ ও এতিমখানা। এসবের আড়ালে তিনি মূলত মাদক ও অস্ত্রের কারবার পরিচালনা করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সেখানে রয়েছে বিভিন্ন পশুপাখির খামার, আছে ফার্নিচার তৈরির মিনি কারখানা। সেখান থেকে কাঠ পাচারের পাশাপাশি এ কাঠের কারখানায় অনেককে অপহরণ করে প্রথমে এনে রাখা হয়, দফারফা না হলে এরপর নিয়ে যাওয়া যায় পাহাড়ের ভেতরে কলোনিতে। গুলি ও কিরিচ চালনায় পারদর্শী নুরুর বর্তমান ডেরাটি ইয়াবার আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে। যেখান থেকে সীতাকু- উপজেলা পর্যন্ত ইয়াবা ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) তথ্যমতে, গত ২৬ ডিসেম্বর আকবর শাহ থানা, গোয়েন্দা বিভাগ ও সিএমপির রিজার্ভ ফোর্সসহ শতাধিক পুলিশ সদস্যের যৌথবাহিনী নুরুর ডেরায় অভিযানে যায়। তখন নুরু বাহিনী হামলা শুরু করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে শটগানের ৫০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আকবর শাহ থানার ওসি মো. জহির হোসেন বলেন, ‘অপহরণ, চাঁদাবাজি, পুলিশের ওপর হামলা, মাদক ব্যবসা, জুয়ার আসর বসানো এবং লেকের মাছ লুটসহ বিভিন্ন অপরাধে নুরুর বিরুদ্ধে ২৪টি মামলা রয়েছে। সম্প্রতি তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা করে তার লোকজন। তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, আমরা সেসব রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করছি।’
নুরুকে একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী অভিহিত করে এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তার (নুরু) আস্তানায় অভিযান চালিয়ে আমরা কাঠ কাটার বিভিন্ন মেশিন জব্দ ও কিরিচ উদ্ধার করেছি। আমরা তার সহযোগী আজমকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া গতকাল অভিযান চালিয়ে নারীসহ আরও ১২ সদস্যকে আটক করেছি। এলাকা অপরাধমুক্ত রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। নুরুকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা অব্যাহত আছে। তার পৃষ্ঠপোষক যেই হোক না কেন, তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: